আমার বাল্যবন্ধু

আজ কাল আমার বাল্যবন্ধুটিকে খুব মনে পড়ছে যে ছিল আমার নিত্য দিনের সহচর এবং খেলার সাথী। আমার মা'ই ওকে লালন-পালন করেছিলেন।

আমি যখন দুদ্ধপোষ্য শিশু, আমার মা তখন ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য হেকিমি ঔষধ সারিবাদী সালসা সেবন করতেন। ফলে মায়ের দুধ একেবারেই শুকিয়ে গেল। মা আমাকে নিয়ে পড়লেন বিপাকে, নতুন মা আবার আরো একটি শিশুর দায়িত্ব নিয়েছেন সেচ্ছায়। সেই থেকে আমার আর ওর গরুর দুধ এবং কৌটা মায়ের দুধই হলো শেষ ভরসা।

আমার এখনো মনে আছে, সেই যে মজা পেয়ে গেলাম গ্লাস্কো মিল্ক, অস্টার মিল্ক, লেট্রোজেন এবং আরো কত কি ছিল। তখন কাঁচের ফিডার ছিল, দু'দিকে নিপল। দুধ বাসি হলে কিংবা অর্ধেক খাওয়া রেখে গেলে সেটা অন্য আরেকটা ফিডারে ভরে ওকে খাইয়ে দিতেন। এই খাবারে তার পেট ভরে না, মার পিছু পিছু ঘুরতো। মা ভাতের মাড় রেখে দিতেন ওর জন্য। এভাবে আমি ৬ বছরে পা দিলাম, নিজেই দুধ বানিয়ে ফিডারে ভরে সারাবাড়ী হাটি আর খাই। আমরা দুজনই দুধ ছেড়ে ভাত ধরলাম। ও ছিল ছেলে, আমার সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে সে। ওর মা ছিল না আমার মাকেই ওর মা ভাবতো। মা আমাদের দুজনকে একটা বিস্কুট হলে ভাগ করে দিতেন। ও সব সময় আমার সাথেই থাকত। মা আদর করে নাম রেখেছিলেন "বুলু''।

বুলুর মা কিভাবে মারা গেলেন? বলছি,


আমার মার কাছ থেকেই শুনেছি, তিনি সবে মাত্র সদ্য জননী। আমাদের ঘরের পাশেই ছিল, বিরাট বাঁশঝাড়। মার হঠাৎ নজরে পড়লো একটি মা তার অসুস্থতার জন্য বাচ্চাকে ঠিক মত দুধ খাওয়াতে পারছেনা। দুটো বাঁশ আড়াআড়ি(কেঁচির মত)মাঝখানে কোন রকম দাঁড়িয়ে দুধ খাওয়াচ্ছেন। আমার মা বাচ্চাটাকে নিয়ে এলেন। ঐ দিন তার মা ইন্তেকাল করলেন।

আমি আর বুলু যেন "দাদাভাই"র আদর নিতে রীতিমত প্রতিযোগিতায় নামি, কে কার আগে সব চেয়ে কাছে বসা যায়। দাদাভাই দুজনকেই সমান আদর করতেন। আমার খুবই হিংসে হতো। বুলু না থাকলে সবটুকু আদর আমিই পেতাম । কেন যে মা ওটাকে আনতে গেলো। আবার ও যখন আমার সাথে খেলতো তখন ভাবতাম আহারে বেচারার মা নেই। আমার আর ওর দারুন এক দুরন্তপনায় কাটছে শৈশব।

তখনো আমরা গ্রামেই, আমার বুঝার ৬টি এবং না বুঝার ৬টি বছর কেটেছে গ্রামেই এ-গাছ থেকে ও-গাছে কার গাছে কোন ফল পেঁকে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, সেই চিন্তায় সারাক্ষণ অস্থির আমি।

বুলু গাছে উঠতে পারেনা, নীচে আমাকে পাহারা দেয় । মসজিদ এবং মাজ়ার এর ঠিক মাঝখানটায় আমাদের কয়েকটা কাঁঠাল গাছ ছিল। কাঁঠাল যখন ২/৩ ইঞ্চি বড় হতো, সেই থেকে দাদাভাই আমি আর বুলু মিলে গোনা শুরু করতাম। গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত ধরে থাকতো কাঁঠাল। আমি প্রায় দিনের বেশীর ভাগ সময় গাছে চড়ে থাকতাম, কারণ ঐ গাছে অনেক সুন্দর করে "টুনটূনি" বাসা বাঁধতো। কাঁঠাল পাতার সাথে এক ধরনের আঠা দিয়ে শক্ত করে জুড়ে পাতাগুলি দিয়ে বাসা বানাতো পরম মমতায়। ঝড় এলে আমার ভয় হতো বাসাটি ভেঙ্গে গেলো কিনা? মাত্র ছানাগুলি ডিম থেকে বের হলো। কার বাসায় ক'টা ডিম কখন ফুটবে, আমার আর বুলুর এই চিন্তা।

আমাদের গ্রামখানি ছবির মতই সুন্দর, শহরে যেতে হলে (তখন) প্রায় কোয়ার্টার কিলোমিটার পর আমাদেরই প্রিয় সেই "খোয়াই" নদী পার হতে হত। বাবা, চাচারা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্য কেউ আসার সময় হলেই , বুলু গিয়ে নদীর পাড়ে বসে থাকে। রাত হোক আর দিন হোক। একদিন শীতের সকালে দাদাভাই, পুকুর পাড়ে ইজি চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছেন। এই সুযোগে বুলুর কি কান্ড দেখুন, তখন তার কোলে উঠার বয়স নেই।

আমি অনেক দূর থেকে দেখছি পাশে বসে তার মাথাটা দাদাভাই এর কোলের উপর। রাগে দুঃখে আমার কান্না আর চেচামেচিতে বাড়ি সুদ্ধ অস্থির। বাড়ির ভেতর থেকে দাদী রেগে মেগে বলছেন। "তোর দাদার ঢং দেখে আর বাঁচিনা, নিজের নাত্নিকে কাঁদিয়ে কেমন কুত্তার বাচ্চা কোলে নিয়ে আবার বসে বসে হাসছে।"

দাদাভাই আমাকে কাঁদিয়ে ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছিলেন হয়তোবা। বুলু তখন পূর্ণ বয়স্ক হয়েছে তার ডিউটি আরো বেড়ে গেল। রাতে কিংবা দিনে অপরিচিত কোন মানুষ, সে চোর/ডাকাত হোক আর পুলিশ হোক, আমাদের অত্র এলাকায় ডুকতেই পারবেনা। বহুদিন এমন হয়েছে, থানা পুলিশ আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে যাবেন পাশের গ্রামে আসামি ধরতে কিন্ত বুলু বাধা দিচ্ছে। উনারা আমার দাদাকে ডেকে বলেন সৈয়দসাব আপনার কুকুর সামলান। দাদা শুধু বুলু বলে ডাক দিলেই সে চুপ।

আপনার নিশ্চই বুঝতে সমস্যা হচ্ছে? আ্মি একবার বলছি "দাদাভাই" আবার বলছি "দাদা" উনারা কিন্ত ব্যক্তি দু'জন। দাদাভাই হলেন, আমার বাবার বাবা(পিতামহ) আর "দাদা" হলেন আমার বাবার মামা। দাদাভাই ও দাদা উনারা ছিলেন কাজেন ব্রাদার। দাদা নিঃসন্তান, তাই যত স্নেহ, মায়া, মমতা ছিল সবই উজাড় করে আমাদেরকে দিয়েছেন।

আমাদের মসজিদের সাথেই ছিল একটি ছোট্ট টিনের ঘর ওই ঘরটায় দূর-দূরান্ত থেকে কোন ক্লান্ত পথিক এলে একরাত্রি যাপন করতেন।

একবার এক মুসাফির আমাদের বাড়ীতে এলেন। বারান্দায় ছোট মাদুর বিছিয়ে খুব যত্ন করে দাদা মুসাফিরকে খাওয়াচ্ছেন আর দাদীর রান্নার প্রশংসা করছেন। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে, দাদার সতর্কবাণী গুলো বলতে থাকলেনঃ "খবরদার রাতে একা বের হবেন না, বাড়ীতে ১টি হিংস্র কুকুর আছে। তাছাড়া জ্বীনরা প্রতিরাত দ্বিপ্রহরে বের হন মাজার জিয়ারতে।" দাদা নিশ্চয়ই নিজেও ভয় পেতেন, লোকটি কোন ক্রিমিন্যাল সদস্য কিনা, তাই এসব কথা বলতেন।

মুসাফিরকে তার প্রয়োজনীয় সব জিনিষপত্র দিয়ে দাদা ভেতর বাড়ীতে এসে শুয়ে পড়লেন। ফজরের নামাজ পড়ার জন্য বের হলেন, সংগত কারণেই জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখেন মুসাফির নেই। দাদার হট্টগোলে আমার ঘুম ভাংলো কি হয়েছে দেখার জন্য। মুসাফিরখানার দিকে যেতেই লাঠি হাতে দাদা তাড়া করলেন "ওদিকে যাবিনা!" সবই গোলমাল লাগছে। কি হলো? একটু পর বুঝতে পারলাম।

আমিনা ঝি (দাদীর পালিত মেয়ে) হাতে মুসাফির এর ব্যবহৃত কাঁথা-কম্বল পাশের ডোবায় ধৌত করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। বেচারা ভয়ের চোটে প্রাকৃতিক বড় কর্মটি বিছানায়ই সেরে ফেলেছে। লজ্জায় ফজরের আগেই বিদায় নিয়েছে।

একদিন সকালে দেখি বুলুর সাথে অপরুপা এক সুন্দরী। সবাই বলছে ওটা বুলুর বৌ, আমি অবাক বুলুর বিয়ে হলো কখন? ওরা দুজন নিশ্চিন্তে বসবাস করছে।

কিছু দিন যাওয়ার পর এক বিকেলে,

আমার বাবার শিক্ষক জগৎপণ্ডিত মশাই উনি খালের ঐ পাড়ে পাশের গ্রামেই থাকেন। দাদার কাছে এসে অত্যন্ত বিনীত ভাবে বললেন, উনার অতি আদরের পোষ্যকে ছলে বলে কৌশলে বুলু ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। দাদার খুব শান্ত একটি জবাব ছিল, "পণ্ডিত মশাই আপনি ওকে নিয়ে যান।" খুশী হয়ে তিনি তার পোষ্যকে (বুলুর বৌকে) নিয়ে বাড়ী চলে গেলেন। পরদিন ভোরে বুলুর বৌ এসে হাজির। এই ভাবে বহু বার নিয়ে গেছেন, আবার চলেও এসেছে।

এদের নিয়ে দাদা মহা বিপাকে পড়লেন। বুলুর বৌকে নিয়ে নতুন আরো কিছু সমস্যা যোগ হলো। এ-বাড়ী ও-বাড়ী থেকে নালিশ আসা শুরু করলো; লোকজন এসে বলছে আমার ছাগলকে কামড়িয়েছে; কেউ বলছে আমার গরুর বছুরকে কামড় দিয়েছে। অন্যজন বলছে আমার ছেলেকে তাড়া করেছে। অতিষ্ট হয়ে দাদা একটা নৌকা ভাড়া করে ভাটি অঞ্চলে বুলুর বৌকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন।

চারদিকে পানি, এরকম একটা দ্বীপের মত যায়গায় বুলুর বৌকে নিয়ে গেলেন। খাবার দিয়ে ওকে রেখে আসতে রাত হলো। পরদিন দাদা খুশী মনে ফজরের নামাজ পড়তে বের হবেন, কিন্ত একি? নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছেন না। বুলু আর তার বৌ এক সাথে বসে গল্প করছে। নিশ্চয়ই তারও একটি সুন্দর নাম ছিল, "সন্ধ্যামালতী" কিংবা "চন্দ্রমল্লিকা" এই জাতীয় কিছু হবে হয়তো।

***

আর মাত্র চার দিন বাকি, দাদার সাথে আমার পাকাপাকি কথা হয়ে গেছে। আমাকে পৌষবান্নিতে (গ্রাম্য মেলাতে) নিয়ে যাবেন। আমার রাত-দিন শেষ হয় না আনন্দে। কি কাজে দাদা শহরে গিয়েছিলেন। এসেই আমাকে ডাকাডাকি শুরু করলেন। গিয়ে দেখি একটা প্যাকেট খুলে আমার জন্য ১টি শাড়ী বের করছেন। ওটা নাকি নীলাম্বরী শাড়ী। গাঢ় নীল রং শাড়ীর লাল পাড়ে জড়ির কারু কাজ করা ছোট্ট একখানা তাঁতের শাড়ী। আমার ছোট্ট ভাইটির জন্য এনেছেন সাদা পাঞ্জাবী, পায়জামা, টুপি, ছাতা ও ছোট একটি লাঠি ।

অবশেষে আসলো সেই দিনটি,

আমার ছোট ভাইকে বান্নিতে নিতে দাদার আপত্তি, কারণ ও হেটে এত দূর যেতে পা্রবেনা। চুপিচুপি আমাকে ডেকে বললেন সময় হলে তুই তৈরী হয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি।

আমি অপেক্ষা করছি, দাদা বের হলেন সাথে বুলু। দাদা জিজ্ঞেস করলেন বুলুকে "কিরে, তুইও যাবি নাকি?" সে লেজ নেড়ে সম্মতি দিল। শুরু হলো পথ চলা। বুলু আমাদের আগে আগে দৌড়াচ্ছে, আমি তার সাথে দৌড়াচ্ছি। ওটা কোন পথ নয়, ফসল তোলার পর ধান ক্ষেতের আইলের মাঝের সরু রাস্তা। অনেক বার হোচট খেয়ে পড়ে আবার উঠছি। দাদার লাঠি দিয়ে দেখালেন ঐ তো আমরা এসে গেছি। প্রথম ডুকতেই দেখি কাঁচের গ্লাসে তোকমা, ইসবগুল আর বরফকুচি দিয়ে লাল সরবত নিয়ে বসে আছে একজন। দাদা আর আমার জন্য দুগ্লাস নিলেন। পাশের দোকান থেকে ১টা মাটির পাত্র কিনে বুলুকেও সরবত দিলেন। তারপর ঘুরে ঘুরে আমার পছন্দের সব খাবার এবং জিনিষপত্র কিনলেন। আমরা কলাপাতায় গরম গরম জিলাপী আর মিহিদানা খেলাম। মাটির হাড়ি-পাতিল, পুতুল, ষাঁড়, মহিষ, ঘোড়া, বাঁশী, ঝুনঝুনি আরো কত কি কিনলাম। খাবার ছিল অনেক রকম, বাতাসা, কদমা, মোয়া, মুড়ালী, খই, উকড়া, লাল আখ আর কাটাগজা।





এবার বাড়ী ফেরার পালা। বের হতে যাব এক জায়গায় দেখি হাওয়াই মিঠাই। আমি দাদাকে বলি "আমি ওটা নেব।" চারখানা মিঠাই কিনে দাদা খুব ভালো করে কাঁধের গামছায় বেঁধে নিলেন।

আমরা হাটছি কিছুক্ষন পর বাড়ী পৌঁছে যাবো।

বাড়ি পৌছে দাদা বিশ্ব জয়ের আনন্দে হাক-ডাক করছেন। আমি কাছে গেলাম আমার জিনিষ পত্র থলে থেকে এক এক করে বের করছেন। কিন্ত হায়! আমার এত সাধের পুতুলের নাক ভাংগা, মহিষের শিং নেই, ঘোড়ার সামনের পা দুটো নেই। মাটির হাড়ি মাঝখানে দুটুকরো আমার মেজ়াজ় একটু একটু করে বিগড়াচ্ছে। দাদারও মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। অবশেষে গামছা থেকে হাওয়াই মিঠাই বের করলেন, কিন্ত একি? ছোট ছোট চারটি চিনির পুটলি পড়ে আছে, সব মিঠাই হাওয়া? অমনি আমি এক দৌড়ে উঠোনে গিয়ে, গড়া-গড়ি দিয়ে চেচামেচি করে কাঁদতে শুরু করলাম। বুলু চুপচাপ আমার পাশে বসে আছে। সে নিশ্চয়ই বুঝেছিল যে, আমার কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে।

আমি তো আগেই বলেছিলাম, আমাদের গ্রামখানি খুবই সুন্দর তারচেয়েও বেশী সুন্দর আমাদের বাড়ীখানা। ছায়াঘেরা শান্ত সু-শীতল পরিবেশ। বাড়ীর সামনেই বিরাট বড় বাংলো। তারপর বিশাল উঠোন। উঠোন পার হলেই মস্ত বড় পুকুর। এই পুকুরে মলা-ঢেলা থেকে শুরু করে রুই-কাতলা পর্যন্ত খুবই সু-স্বাদু মাছ আছে। আহারে চাচার সাথে বড়শী নিয়ে কত চেষ্টাটাই না করেছি, একটি মাছ ধরার জন্য। আমার জীবনে একটা তিতনা পুঁটিও ধরতে পারিনি আফসোস নয়।

জীবনে ২/১ বার এমন সুযোগও এসেছে, ঘুম থেকে উঠেই দেখি পুকুর পাড়ে লোকে লোকারন্য। ভিড় ঠেলে কাছে যেতেই দেখি, পুকুরের সব মাছ মরে ভেসে উঠেছে। পুঁচকো-পাঁচকোরা সেই ভেসে উঠা মাছ গুলি ধরছে। আমিও নেমে পড়লাম। কি যে উল্লাস আর আনন্দ, আমার ভাব খানা এমন বড়শীতে তোকে ধরতে পারিনা, এবার পেয়েছি হাতের কাছে তোকে। বাড়ীর সবার মন খারাপ, কেন যে মন খারাপ তা বুঝতাম না। এখন বুঝি কিছু কিছু মানুষ, যুগে যুগে জন্মায় নাশকতা এবং ধ্বংসাত্বক মানষিকতা নিয়ে। এরা অন্যের ক্ষতি সাধন করে এক ধরনের পৈচাশিক আনন্দ পায়, এদের কে আমি "মানুষ" মনে করিনা। বছরে ২/১ বার জেলে ডাকা হতো, ঐ দিন উৎসবের আমেজ সারা বাড়ীতে। মাছ ধরা শেষ হলে বাড়ীর বৌ-ঝিরা মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে বসে যেতেন দা-বটি নিয়ে চাটাইয়ের উপর। বাড়ীর সাহেবরা চার পাশে গোল হয়ে চেয়ার পেতে বসে যেতেন। কাটা মাছ সমবন্টন হতো। কেউ কেউ আবার সব চেয়ে বড় মাছের মাথাটার জন্য মুখ ভার করে ঘরে যেতেন।

আমি খেয়াল করে দেখলাম, বুলু আর আগের মত আমার সাথে খেলে না। চুপ-চাপ বসে কি জানি ভাবে, খাওয়া দাওয়াও ঠিক মত করেনা। বাংলোর উত্তর দিকে মসজিদ, মাজার এবং পারিবারিক কবরস্থান। মসজিদের পাশেই ছিল ছোট্ট সেই মুসাফির খানাটি যা এখন আর নেই। দাদার প্রিয় এই জায়গাটিতে পাশপাশি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন দাদা আর দাদী। আমার বাবার "মা" (আমার দাদীকে) কোনদিন দেখিনি, কিন্ত যাকে আমি দাদী বলি উনার চাইতে বেশী স্নেহ করতেন কিনা জানিনা। দাদীর কথা আজ আর বলব না, তাহলে এটা উপন্যাসে রুপ নিবে।

***

আমাদের বাংলো ঘরের বহুবিধ ব্যবহার বার মাস লেগেই আছে। গ্রামের কোন বিচার-বৈঠক(শালিস)এখানেই হতো। ২৮ ও ১২ গ্রামের গন্য-মান্য ব্যক্তি বর্গ আসতেন বিচার কার্য সমাধা করতে। ২৮ গ্রাম হচ্ছে হাই-কোর্ট এবং ১২ গ্রাম হচ্ছে জজ-কোর্ট। হাই-কোর্ট এবং জজ-কোর্ট এর বিচারের রায় এই গ্রামেই দেয়া হতো, সবাই তা মেনে নিত। সারা রাত চলতো বিচার। মাঝরাতে দাদা কোথ্যেকে একটা খাসি এনে জবাই করে, উনাদের খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলতেন। বিরাট ডেকচিতে রান্না হতো। খাশীর গোশতের রেজালা আর শিং মাছ দিয়ে মাসকলাইর ডাল। বড় এক পাতিলে চা বসানো হতো। গুড়, চাপাতা, দুধ এক সাথে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে, একে চায়ের খিচুড়ীও বলা যেতে পারে। চায়ের সাথে সুপার বিস্কুট আর পান-তামাক তো আছেই।

একবার আমার ছোট ভাইটি বায়না ধরলো খাসির আস্ত মাথাটা সে খাবে। দাদী মাথা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন, মাথা তো আর পাওয়া যাচ্ছে না, ডেকচিতে শুধু জাল ফেলাই বাকি ছিল। এদিকে দাদার হম্বি-তম্বি, পারলে দাদীকেই ডেকচিতে নামিয়ে দেন। আমাদের জন্য দাদীর অনেক বকুনী ও কটু কথা শুনতে হয়েছে(দাদার পক্ষ থেকে)। চুন থেকে পান খসলেই কুরুক্ষেত্র। অবশেষে দেখা গেলো খাসির আস্ত মাথাটা এতো বড় পাতিলে ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে।

বাড়ীতে বিয়ের উৎসব হলেও ঐ বাংলোতেই হতো। বিয়ে মানে বিয়ে, আজ কালকার ডিজিটাল রেডিমেট বিয়ে নয়। সপ্তাহ ব্যাপী চলত এর আয়োজন, সারা বাড়ী গম-গম করতো অতিথিদের আগমনে। দুর দুরান্ত থেকে আসতেন সব আত্নীয় স্বজন। হ্যাজাক বাতির আলোয় সারা বাড়ী ঝলমল করতো। বাড়ীর প্রবেশ দ্বারে কলাগাছ, খেজুর পাতা বাঁশ ও রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো হতো বিশাল গেট। কাগজের ঝালর, ফুলপাতা, শিকল দিয়ে বাংলোকে সাজাতেন তরুনরা। সেই গেট পার হতে বরের অবস্থা কাহিল। বরযাত্রীরা সবাই মেঝেতে পাতা সুন্দর বিছানায় বসতেন। দস্তরখানা সামনে পেতে খাবার পরিবেশন করা হতো। বাড়ীর বেয়ারারা চিলুমচি আর জগ হাতে সবার সামনে গিয়ে হাত ধুইয়ে দিতেন। বরের সামনে এলেই তাদের চোখ চকচক করতো, বরের রুমালে বাঁধা কাঁচা পয়সা ঝনঝনিয়ে পড়তো চিলুমচিতে।

সারারাত ব্যাপী বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান। সময় হাতে বেশী থাকতো তো তাই, অকারণে বর-কনে উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয়ে যেত কিছু অনাকাংখিত ঘটনা, মনোমালিন্য এবং ঝগড়া ফ্যাসাদ। মেঝেতে সুন্দর বিছানা পেতে একপাশে মছলম-তকিয়া দিয়ে তৈরী হতো বরের আসন। সেখানে চলত বিয়ের নানান কার্যক্রম। ভোরে(সুবহে-সাদিকে) বর-কনেকে একসাথে বসানো হবে, বর অন্দর মহল আসবেন। সেজন্য আমরা সারা রাত জেগে থাকতাম। যে যে ভাবে পারে শুধু উল্লাস আনন্দ কর। তার মধ্যে ছিল বিয়ের মিষ্টিচুরি। বাড়ীর চাচারা (জুনিয়র)আমাকে পাঠাতেন, ভাতিঝি পেছনের দরজাটা শুধু তুই খুলে দিবি, বাকি কাজ আমাদের। মিষ্টির হাড়ি চুরি করার পর সেটা মাঝ উঠোনে এনে ফেলে দিতেন। হুড়মুড় করে সবাই সেই মিষ্টি কুড়াচ্ছে। যারা উদ্যোক্তা তারা নিজেদের জন্য পানির জগে মিষ্টি ভরে সেটা সুপারী গাছের আগায় গামছা দিয়ে বেঁধে রেখে দিয়েছে। পরে সময় করে তারা পুকুর পাড়ে বসে সেই মিষ্টি খাবে। চুরি না করে কি উপায় আছে? হাড়কিপ্টে বুড়ী কাউকে মিষ্টি দিবেনা। মিষ্টি পঁচে গেলে বের করবে, তখন বুলুও একটু শুকে মন খারাপ করে চলে আসবে। বেচারা বুলুরও বিয়েতে আনন্দ কম না কোর্মা, কালিয়া, মাংসের হাড়গোর বেশ মজা করে মটমটিয়ে চিবিয়ে খায়।

এই বছর সব চাইতে শ্রেষ্ঠ কাজে লেগেছে আমাদের বাংলোটি। মসজিদের নির্মান ও সংস্কারের কাজ চলছে, তাই মসজিদের যাবতীয় কাজ কিছুদিনের জন্য এই বাংলোতেই হচ্ছে। তাহলে আমি ধরে নেব এটাই বর্তমানে মসজিদ।

আজ ১২ই রবিউল আউয়াল, রোজ শুক্রবার। আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। বিশ্বের সমগ্র মুসলিম উম্মার জন্য, এ দিনটি খুবই তাৎপর্যপুর্ণ। আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মনটা খুশীতে ভরে গেল। আমার বন্ধুরাও আমার মতই খুশী, কেন? তা শুধু চুপিচুপি আপনাকেই বলছি, কাউকে বলবেন না যেন। আজ শুক্রবার তার মধ্যে ঈদে মিলাদুন্নবী। আজকে কত রকমের না সিন্নি আসবে মসজিদে। এবার নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন খুশির কারন?

কত রকমের সিন্নি যে গ্রামের মসজিদে আসে। জিলাপী, খোরমা, নকুল, বিস্কুট তাছাড়া ডাইলে চাউলে খিচুড়ী। কেউ নতুন ধান ঘরে তুলেছেন, মসজিদে একটু সিন্নি দিয়ে নিজে খাওয়ার নিয়ত করেছেন। সেই ক্ষেত্রে ধনী পরিবার থেকে এসেছে ভাত আর গোশবিরানী। মুরগীর নরম মাংশগুলো কুচিকুচি করে কেটে শুকনো গোশবিরানী। কেউ আবার শুধু ভাত তার সাথে আলু,সীম নিরামিষ বাঁশের ঝুড়িতে করে দিয়ে যেতেন। সাথে কলাপাতা, কলাপাতায় সিন্নি খাওয়ার কি যে মজা। আর এক ধরনের সিন্নি ছিল। সম্পূর্ন কাঁচা চালের গুড়ার সাথে কলা, আখের গুড়, নারকেল ও চিড়া মিশিয়ে একটা মন্ড তৈরী হত। ঐ সিন্নি আমি কাঁচা খেতে পারতাম না। কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে চুলার আগুনে পুড়িয়ে খেতাম। পোড়া পোড়া একটা গন্ধ, বেশ ভালই লাগতো। কারো গাভীর বাছুর জন্মেছে, দুধের সিন্নি মসজিদে প্রথম দিতে হবে। শুধু দুধের মধ্যে চাল দিয়ে রান্না। একটু নুনও না গুড়ও না। এটাই কলাপাতায় চেটেপুটে খেতাম। কি কু-সংস্কার ভাবুন তো নুন/গুড় দিলে নাকি গাভীর অকল্যাণ হবে। এর কি কোন মানে হয়?

আমাদের মসজিদে একজন ইমাম সাহেব আছেন। তবুও আজকের স্পেশাল দিনে, দাদা নামাজ পড়াবেন। তিনি পীর সাহেব, দেশে বিদেশে উনার অসংখ্য ভক্ত ও মুরিদান আছে। নামাজ শুরু হয়ে গেল। আমরা একটু দূরে কাঁঠাল তলায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, যাতে আমাদের কিচিরমিচির নামাজের বিপত্তি সৃষ্টি না করে। খুৎবা শেষ। দাদা নাক ঝাড়তে নাকি থুথু ফেলতে বাইরে এসেছেন। দাদার বুক ফাটা আর্তনাদে আমরা সবাই দৌড়ে এসেছি। দাদা কেঁদে কেঁদে বলছেন "বুল্লারে তোকে দ্বীন ইসলামের হাতে সঁপে দিলাম। আরও বলছেন...হায় আল্লাহ রহমানুর রহিম, ঐ কুত্তাটার মত যদি আমার মরণ হতো।"

বুলু টান টান হয়ে শুয়ে আছে। লম্বা বারান্দায় তার মাথাটা উত্তর দিকে, মুখটা কেবলা মুখে। দাদাভাই এসে দাঁড়ালেন পাশে, চোখ ছলছল করছে। দাদাভাইর মুখে শুধু একটা কথাই শুনলাম। উক্তিটি আজও আমার মনে আছে, "যদি আমরা পূনর্জন্মে বিশ্বাস করি, তাহলে আমি বলব আমাদের পরিবারের কাছে বুলুর কোন ঋণ ছিল তা এজন্মে এসে শোধ করে গেল।" মুসুল্লীরা বের হয়ে একটু দুরের খাল পাড়ের বাঁশঝাড়টায় বড় গর্ত করে বুলুকে মাটিচাপা দিলেন।

আমি কি কেঁদেছিলাম? আমার ঠিক মনে নেই। ঐ সময়টায় আমি সম্পূর্ণ ঘোরের মধ্যেই ছিলাম। এদিক ওদিক শুধু দৌড়াচ্ছি। ভিতর বাড়ীতে এসে যখন দেখি, বুলুর বসার জায়গাটা শূন্য, খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমার এ জীবনে অসংখ্য প্রিয়মুখ আমি হারিয়েছি। কখনো নীরবে নিভৃতে মনে করার চেষ্টা করলে বুলুর মুখটা দূরে থেকে উকি দেয়।

আমার বাল্যবন্ধুর কথা এখনেই শেষ হতে পারতো কিন্ত তার সাথে যে আরও একটি জীবন জড়িত, সে বুলুর বৌ।

তিন মাস পরের কথা। বুলুর বৌ খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। শুধু বসে থাকে বুলুর চিরনিদ্রার স্থানটির উপর। তাকে কোন মতেই বাড়ীতে আর আনা যাচ্ছে না। দাদা প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছেন। একদিন সকাল বেলা গিয়ে দেখি, কিছু দাঁড়কাক ও পাতিকাক তার পেট থেকে নাড়িভূড়ি বের করে খাচ্ছে। একটু দূরে কয়েকটা শকুন অপেক্ষায় আছে। বুলুর বৌ মরে গেছে, একটু কাছে যেতেই অস্ফূট একটা গোংগানীর শব্দ পেলাম। দুটো চোখ পিটপিট করে আমার দিকে চেয়ে আছে। শব্দ করার শক্তিটুকু আর অবশিষ্ট নেই তার। দৌড়ে এসে দাদাকে খবর দিলাম। দাদা এসে উভয় সংকটে পড়ে গেলেন। কি করা যায়? কাক-শকুন কে পাহারা দিবে? তার প্রাণটা তো এখনও আছে। এ অবস্থায় মাটিচাপা দেওয়াও সম্ভব নয়। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। ছেলে বুড়ো সবাই এসে ভীড় জমাচ্ছেন বাঁশঝাড়ের নীচে। মুরুব্বী, মাতব্বর একেক জন একেক মন্তব্য করছেন। তার মাঝখান থেকে একজন বর্ষীয়ান বলে উঠলেন, পণ্ডিত মশাইকে খবর দেওয়া দরকার, উনার প্রিয় পোষ্যকে উনি যদি খাস দিলে মাফ করে দেন তবেই তার প্রাণটা শান্তি পাবে। দাদা আর দেরী করেন নাই। লোক পাঠানো হলো পণ্ডিত মশাইর বাড়ীতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই জগৎ পন্ডিত মশাই এসে পড়লেন। খুব ধীরে ধীরে কাছে গেলেন, উনার চোখ দুটো ছল ছল করছে। এবার চোখ বন্ধ করে কি যেন মন্ত্র পাঠ করলেন। বুলুর বৌ আস্তে করে তার চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণ পর পন্ডিত মশাই কারো সাথে কোন কথা না বলে উনার বাড়ীর পথে রওয়ানা হলেন।

No comments:

Post a Comment