জাতীয় পতাকার গল্প

ইসলামী ব্যাংক রংপুর শাখায় মাকড়সার
ঝাড়ুতে ঝুলছে জাতীয় পতাকা
আমার শিশু পুত্রটিকে যখন স্কুলের দোলনা শ্রেণীতে প্রথম ভর্ত্তি করালাম(১৯৯৪)। মা-ছেলে দু'জনেরই ব্যস্ততায় সময় কাটছে। এবং তার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতাও হচ্ছে (হয়তো সব মায়েদেরই এমনটা হয়)।

ভর্ত্তির চার দিনের মাথায় প্রথম সাময়িক পরীক্ষা । আমি হেড মিস্ট্রেসকে জানিয়ে দিলাম যে, "আমি চাই আমার ছেলে পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করুক এবং পরীক্ষা কি সে বুঝুক।"

আসলো সেই দিনটি।

আমাকে ছাড়া সে ক্লাসরুমে বসবেনা। বাধ্য হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ বারান্দায় চেয়ার, টেবিল এনে পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন।

ফলাফল হলো...

জ়বানীতে (মৌখিক)সর্বোচ্চ নাম্বার পেলেও লিখিত পরীক্ষায় দু'টো করে ডিম, ''আলহামদুলিল্লাহ''।

স্কুলটা ছিল রাজধানীর মধ্যেই একটি কিন্ডারগার্ডেন। ওদের নিজস্ব ভবন বলে, এক চিলতে খেলার মাঠও ছিল। এভাবেই চলছে দিন।

একদিন রাতে ছেলে আমাকে প্রশ্ন করলো, "আচ্ছা মা, ক্লাস শুরু হবার আগে আমরা যখন ব্যায়াম করি, জাতীয় সংগীত করি, তখনই ড্রীল ম্যাডাম বলেন, 'জাতীয় পতাকাকে সালাম দাও!' কিন্ত ওখানে তো কোন পতাকাই নেই?"


তার শিশু মনের প্রশ্নের কোন জবাব আমার কাছে ছিলনা। ও নিজেই বলে, "কাল সকালে আমাদের বাসার ছোট্ট পতাকাটাই নিয়ে যাবো।" আমি বললাম, "আচ্ছা নিয়ে যেও। এবার ঘুমুতে যাও।"

পরদিন পতাকা নিয়ে স্কুলে হাজির। মাঠের কোনায় পড়ে থাকা ছোট্ট লাঠিতে লাগানোর চেষ্টা করছে। এই দৃশ্য দেখে দফতরী দূর থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল, "কি করছো বাবু?" আমি হাসতে হাসতে বলি, "একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পতাকা নেই! তোমাদের বিরোদ্ধে তো কেস হয়ে যাবে!" পতাকা টানিয়ে আমার পুত্র তো মহা খুশী।

টিফিনের পর দফতরী এসে জানালো, "হেড মিস্ট্রেস আফনেরে সালাম দিছেন।" গেলাম উনার অফিস রুমে। সৌজন্য মুলক কুশল বিনিময়ের পর উনি বললেন "আপা, দফতরীর কাছে শুনলাম পতাকা লাগাইনি বলে আপনি বলেছেন, 'আমাদের বিরোদ্ধে কেস হয়ে যাবে'। কথাটা শুনে খুবই দুঃখ পেলাম।"
আমি বললাম, "জ্বী জনাবা, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা নেই। এটিও একটি অপরাধ।

বাংলাদেশের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসাবে ইচ্ছে করলেই এই প্রতিষ্ঠানের বিরোদ্ধে আমি কেস করে দিতে পারি । আমার মত অন্য কেউ ও তা পারে। বিদ্যালয় একটি জড়বস্ত আর তার প্রধান হিসেবে মামলা-মোকদ্দমা, কোর্ট-কাচারী, জরিমানা, শাস্তি, এই সকল ঝামেলা আপনাকেই পোহাতে হবে। তখন কি দুঃখটা আরো বহুগুন বেড়ে যাবে না?" এই বলে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। ঠিক কিছুক্ষন পরই দেখি কোথা থেকে একটি বাঁশ(Unclean bamboo) এনে পরিষ্কার করা হচ্ছে। বিশাল বড় আকারের পতাকা আনা হয়েছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে উনি বললেন, "স্কুলে নির্মান কাজ চলছে তো, তাই পতাকা লাগানো হয়নি । আমার খুবই হাসি পেলো। মনে মনে হাসলাম।

হায়রে বাঙালীর দেশ প্রেম। বিশ্বকাপ কিংবা যে কোন দিবসে পতাকার কি ছড়াছড়ি। বাসা-বাড়ির ছাদে, রাস্তার দু'পাশে অফিস আদালতে সর্বত্র পতাকায় দেশ সয়লাব। মেঘে ভীজে, রোদে শুকায়। সবচেয়ে বেশী খারাপ লাগে যখন দেখি ছোট ছোট কাগজের পতাকা গুলো ভূ-লুণ্ঠিত হয়ে, পদ দলীত হচ্ছে। ড্রেনে, নালায়, নর্দমায় পড়ে থাকতে দেখেছি। এই পতাকা অর্জনের কাহিনী বর্তমান প্রজন্মের কাছে রুপকথার মতই। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা কেউ করেনা।

আবার বাংলাদেশেরই কোন কোন জায়গায়, বিশেষ করে সরকারী বাহিনীতে পতাকার যথাযত মর্যাদা এখনো প্রদর্শন করা হয় ।

চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনে, একদিন পাহাড়ের সিড়ি বেয়ে মাঝ পথে এসেছি। সূর্যাস্তের পূর্বে হঠাৎ ভিউগলের সুর বেজে উঠল। সেই সাথে আমি অবাক হয়ে দেখলাম। ঘোড়া attention, গাড়ী attention,  মানুষজন সবাই যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও মাঝ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। যতক্ষন পর্যন্ত পতাকা নামানোর প্রক্রিয়া চলছে। মনে হল ফুটপাতের ম্যাজিক ম্যানের মত সবার কানে কানে কেউ বলছে, "খবরদার কেউ যায়গা থাইক্কা লড়বেন না, লড়লেই হাড়ের জোড়া ছুইট্টা যাইবো!!" আমার অনেক ভালো লাগলো।

পতাকার ব্যবহারবিধি:-

  • জাতীয় দিবসে সরকারি ও বেসরকারি ভবন, বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন ও কনস্যুলেটে পতাকা উত্তোলন করতে হবে।
  • শোক দিবসে পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পতাকা অর্ধনমিত রাখার ক্ষেত্রে প্রথমে পতাকা শীর্ষস্থান পর্যন্ত ওঠাতে হবে। তারপর অর্ধনমিত অবস্থানে রাখতে হবে। দিনের শেষে পতাকা নামানোর সময় পুনরায় শীর্ষস্থান পর্যন্ত উঠিয়ে তারপর নামাতে হবে।
  • সরকার অনুমতি ব্যতীত জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা যাবে না।
  • জাতীয় পতাকার ওপর কিছু লেখা অথবা মুদ্রণ করা যাবে না। এমনকি কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে কিছু আঁকা যাবে না।


ব্যবহারবিধি উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত

আমার জানা মতে ১৯৭২ সালে একটি আইন করা হয়েছিল। এই আইন কি এখনও বলবৎ আছে? না ভোতা হয়ে গেছে? নাকি আইনের লোকেরা সবাই ছুটিতে চলে গেছেন? একটু অপেক্ষা করুন। আমি গুগল থেকে একটু ঘুরে আসি।

জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতীয় প্রতীকের অবমাননা করলে শাস্তির বিধান রেখে এ সংক্রান্ত সংশোধনী আইন ১ আগস্ট ২০১০-এ পাস করা হয়। আগে বাংলাদেশ জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় প্রতীক অধ্যাদেশ ১৯৭২-এ এ সংক্রান্ত অবমাননার কোনো শাস্তির বিধান ছিল না। নতুন সংশোধিত আইনটিতে ধারা ৪(ক) সংযোজন করে এ ধরনের অবমাননায় সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা ও প্রতীক (সংশোধনী) আইন- ২০১০

জাতীয় পতাকাকে কেউ যদি সম্মান না জানান, তবে অসম্মান করারও ক্ষমতা রাষ্ট্র কোন নাগরিককে দেয়নি।

No comments:

Post a Comment