আমার প্রথম জন্মদিন

আজ আমার জন্মদিন, ছোট বেলা তেমন ঘটা করে কাউকে জন্মদিন পালন করতে দেখিনি, তাই মনে কোন আফসোসও ছিল না। তবে হ্যা আমার মা কিন্ত ঠিক মনে রাখতেন দিনটি। আমাকে না জানিয়ে শহর থেকে ছিট কাপড় আনাতেন। রাতে বসে বসে নিজ হাতে ফ্রক সেলাই করতেন, আবার কুর্শিকাঠা দিয়ে লেস বানিয়ে তা ফ্রকে লাগিয়ে দিতেন।

ঐ দিনটি শুধু মনে রাখার জন্যই এই আয়োজন টুকু। মিষ্টান্ন, পিঠা, পায়েস, আর একটু উন্নত মানের খাবার এই ছিল জন্মদিন।

ঘুম থেকে উঠে দেখি বিছানার চাদর আড়াআড়ি ভাবে আধা ফুট পরিমানে কাটা। বিষয় জানতে চাইলে, দেখি হাসতে হাসতে মা লুটোপুটি খাচ্ছেন। আমি নাকি ঘুমের মধ্যে চোখ খুলে ফেলেছি, তাই বে-খেয়ালে জামার সাথে চাদরও কাটা পড়েছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ছিট কাপড়ের একদিক সোজা অন্য দিক উলটা সেলাই হয়ে গেছে, তা আবার খুলে ঠিক করতে হচ্ছে। ছোট বেলার সেই দিন গুলি খুব মিস করেছি। বড় বেলায় বহু কাল জন্মদিনে মাকে আর পাইনি।

মাকে নিয়ে আমি প্রায় দু-মাস ঢাকার হাসপাতালে আছি। মার অবস্থার কোন উন্নতি নেই। ঠিক ১২টা ১ মিনিটে বাসা থেকে বাচ্চারা ফোন দিয়ে আমাকে উইশ করলো।

এই প্রথম বার আমার জন্মদিনটা ভুলে গিয়ে মাকে খুব লজ্জিত দেখা গেল। গলার আওয়াজ ক্ষীন তবুও শুরু হয়ে গেল, সেই গল্প যা আমি শুনিনি আগে কখনো। সারাটি রাত গল্পের মধ্যেই কাঠলো অন্য রকম এক জন্মদিন।

নানার বাড়ীতে আমি জন্মেছি। আমার নানু বলতেন, যে বছর সব চেয়ে বেশী ধান হয়েছিল সেই বছরই নাকি আমার জন্ম। আঘোন মাস (অঘ্রহায়ন) এটাই হলো বয়সের হিসাব। বাড়ীর উঠোন, বারান্দা, ঘরের ভেতর সর্বত্র ধান আর ধান। আমি খুবই গর্বিত, এশিয়া মহাদেশের সর্ব বৃহৎ গ্রাম বানিয়াচঙ্গ (বানিয়াচং)-এ আমি প্রথম পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহন করি।


মার কাছ থেকে শুনেছি,বিভিন্ন আচার অনুষ্টানের কথা। আমার বয়স যখন ৬ দিন, একজন নরসুন্দর এসে প্রথম আমাকে মাথা মুন্ডিত করেন। প্রথা অনুযায়ী উনাকে পাঁচ সিকে পয়সা, একখানা উন্নত মানের ধুতী, চাল, দু'টো হাঁস, তেল, নুন, মরিচ ও একখানা গামছা উপহার দিয়ে উনাকে বিদায় দিলেন।

মার কথা শুনে মনে পড়লো ৮/৯ বছর বয়সে্র সেই দিনেটি,

কোন এক ঈদে আমরা মামাবাড়ীতে ছিলাম। বড় মামা ঈদের আগের দিন "নরেন্দ্র" দাদুকে বাড়ীতে ডেকে এনেছেন।

আমরা সব ভাই বোন, কাজেন মিলে ডজন খানেক তো হবোই। এতো জনকে সেলুনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তাই, পুকুর পাড়ের ঐ জাম তলায় বসে বসে সবার চুল সাইজ করছেন। আমি আর আমার ভাই ছিলাম না বাড়িতে। আমরা বাড়ীর দিকেই আসছি এটা দেখে বড় মামা দূর থেকেই পরিচয় করালেন, "কাকা ঐ দেখ আমার ভাগ্নী আসছে।"

আমি তখনো জানিনা উনি ৬ দিনের দিন আমার চুল কেটেছেন। একটু কাছে এগুতেই দেখি ছেলে মেয়ে সবাইকে ধরে ধরে মাথায় বাটি বসিয়ে "গোলছাট'' দিচ্ছেন! চুল কাটার এই দৃশ্য আমার পছন্দ হয়নি। আমার ভাই অনেক দূরে রয়েছে, তাকে চিৎকার দিয়ে এদিকে আসতে নিষেধ করছি, "ঐ এদিকে আসবি না গোলছাট, গোলছাট।" বড় মামা শুনে মুচকি হেসে বলেন, "ঈদের আগের দিন লম্বা ছাট কই পাইবি?" আমার এখনো এ কথাটি মনে হলেই, খুব হাসি পায়। আমাদের আর ধরতে পারেন নাই। অবশেষে রাতে বাজারের সেলুনে গিয়ে পছন্দ মত চুল কাটলাম।

মা'র গল্প শুনে নরেন্দ্র দাদুর খোঁজ নিয়ে ছিলাম। জানতে পারলাম, তিনি বহুকাল আগেই গত হয়েছেন। জীবনে প্রথম এবং শেষ বারের মত দেখেছিলাম দূর থেকে উনাকে। উনি কি আমাকে দেখেছেন? ঐ দিন সবার সাথে গোলছাট দিলে কি এমন হতো? মনে একটা অনুশোচনা এখনো কাজ করে। আমার বড়মামা আজ নেই, উনার কথা খুব মনে পড়ে। আষাঢ় মাস এলেই মাকে নাইওর নিতে আসতেন। আমাদের কি আনন্দ মামার বাড়ী যাব। আমরা উজান এলাকার মানুষ, হেমন্ত আর বর্ষার তফাৎ বুঝিনা। মামা বাড়ী ভাটি অঞ্চলে নৌকায় করে যাব, এটাও আনন্দের কারন হতে পারে।



অবশেষে আমরা রওয়ানা হলাম। নৌকা ছেড়ে দিবে কিন্ত বড়মামা কোথায়? একটু পরই দেখা গেলো, দুহাতে পুটলা-পুটলি নিয়ে উপস্থিত। চানাবুট, চীনাবাদাম, মুড়ালী ও নাড়ু আরো কত কি এনেছেন। আস্তে আস্তে নৌকা চলছে, ৩০ মিনিটেই আমি অস্থির আর বসে থাকব না। বাধ্য হয়ে মাঝি আমাকে আর ভাইকে স্থলে নামিয়ে দিয়েছে। হাটতে হাটতে এখন পায়ে ব্যথা, আবার নৌকা। বাপের বাড়ী যাওয়ার জন্য মা'র বিরাট আয়োজন, সাথে খাবার আছে ভাত।বিনোদনের জন্য রেডিও তে চারটি নতুন ব্যাটারী নিতেও ভুল হয়নি। বেতারে গান বাজছে, মা আমাদের খাবার দিচ্ছেন। মুরগীর গোস্ত, ডাটা দিয়ে টেংরা মাছ, নৌকায় বসে খুব মজা করে খাচ্ছি। খাওয়া শেষ হলে মা আদরী ঝি'কে (মার কাজে সহযোগিতা করেন) বলেন "প্লেটটা ধুয়ে আন তো আদরী।"  তখন আমরা মাঝ হাওড়ে। যেই না প্লেট পানিতে ডুবালো, আমার চোখের সামনে দিয়ে হলুদ ফুলের আমার প্রিয় প্লেটটি চির তরে তলিয়ে গেল।

এত পরিস্কার পানি শাপলা-শালুকের শিকড় দেখা যাচ্ছে। আমি তাকিয়েই আছি, আমার প্রিয় প্লেটটি যদি দেখা যায়। বুট বাদাম সাবাড় করেছি অনেক আগেই। মাঝে মাঝে বড়মামা মৎসজীবি নৌকা দেখলেই হুংকার করেন, "ও মাঝি কি মাছ?" তাদেরকে কাছে এনে মাছ কিনছেন। রেডিও তে গান বাজছে। কিন্তু আমার সবই বিরক্ত লাগছে।

মামাবাড়ী থেকে ফেরার সময় অন্য রকম অভিজ্ঞতা। নানু মাকে কি কি দিয়েছেন কে জানে? নৌকা ডুবে ডুবে অবস্থা এবার আমাদের বাড়ীর পাশের খোয়াই নদীতে নৌকা নিয়ে আসতে হবে। তিন মাঝি আছেন, দু'জন নদীর দুই তীরে নেমে বড় দড়ি বুকে বেঁধে উজানের দিকে (গুন টানা) টানছেন। একজন হাল ধরে বসে আছেন। ঐ দৃশ্য দেখে আমার খুব ভালও লাগতো আবার মাঝিদের জন্য কষ্টও হতো।

আমার পুত্রের বয়স তখন ৫ বছর। তার জন্মদিন আমরা ঘটা করে পালন করি। সে বায়না ধরলো মার জন্মদিন করবে। শুরু হয়ে গেল আমার উপর রান্নার তান্ডব; কোরমা, পোলাও, রেজালা, মাটন তো আছেই তার উপর বড় ডিসে পোলাও, এর উপর আস্ত মোরগের রোস্টও রাখতে হবে। কি মুস্কিলে পড়ে গেলাম। আমরা তখন বন্দর থানা কমপ্লেক্সের কোয়ার্টারে থাকি। অত্র এলাকায় দোকান পাটের কোন চিহ্ন মাত্র নেই। এক দফায় বাজার তো হলো, এখন রান্নারই কি যেন একটা জরুরী জিনিষ বাদ পড়ে গেছে। আমার মেজো ভাইটি ভাঙ্গা টেপ রেকর্ডার ঠিক করতে ব্যস্ত।সে আবার এ বিষয়ে অভিজ্ঞ। জন্মদিনের গানও নাকি বাজাতে হবে। যত অডিও কেসেট ছিল, তাও ফিতা খুলে দলা পাকিয়ে রেখেছে আমার পুত্র। সেগুলো আবার জোড়া লাগাতে হবে, অনেক কাজ বাকি তার।

আমার খুব সংকোচ লাগছে কি করে বলি, হঠাৎ বলেই ফেলি "ভাই একটু ফকির হাট যেতে পারবি?" রাগে কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে "আর কি বাকি বোম(আতস বাজী)?"

মাত্রই চট্টগ্রামে দু'তলা বাস তখন নতুন ছেড়েছে। ফকির হাটের ভাড়া আট আনা (৫০ পয়সা)। যাক বোম লাগেনি, তার কাজ করেছিল নোঙ্গর করা ৩ নম্বর জেটির জাহাজ গুলি। কেক কাটা শুরু, তখনই কাকতালীয়ভাবে এক যোগে জাহাজের সাইরেন বিকট শব্দে বেজে উঠল।



পুত্র আমার খাবার ফেলে, এক দৌড়ে বেলকুনিতে হাজির। সে খুব খুশী এই শব্দ শুনে। কি অপরুপ দৃশ্য সামনে সমুদ্র, সারি সারি দেশী/বিদেশী জাহাজ। ক্রেনে মালামাল আনলোড/লোড করছে। দুরের কন্টেইনার গুলি দেখতে দেয়াশলাই বাক্সর মতই মনে হচ্ছে।


গাড়ীগুলি দেখতে মনে হবে থরে থরে শোকেসে সাজানো খেলনা। আমার জন্মদিন পালন সেই থেকে শুরু, আজ পর্যন্ত তা বলবৎ আছে।


আমি দাঁড়িয়ে আছি খোলা সেই বেল কুনিতে যেখানে ভেজা কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়ালে বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে মাইল খানেক দূরে। দিন শেষে শাড়ী কাপড় আনতে গিয়ে দেখব, বাতাসে বড় সাইজের একখনা দড়ি পাকিয়ে রেখেছে। বাসার সামনে সমুদ্র আবার পেছনেও স্থল সমুদ্র (বিশাল বড় রাস্তা)।

এত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শহর। দিনের বিশেষ একটা সময় সব কাজ ফেলে বসে থাকি শুধু মাত্র একটি দৃশ্য দেখার জন্য। নীমতলী প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চারা কিভাবে রাস্তা পার হচ্ছে। একজন মাসী আছেন, ধবধবে সাদা ধুতী পরা, গলায় তুলসীর মালা, কপালে চন্দনের তিলক। বয়স ৫০/৫৫ হবে। উনার কাজ বাসায় বাসায় গিয়ে সব ছাত্র/ছাত্রী একত্র করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া। তিনি যা করেনঃ- বড় থেকে ছোট বাচ্চাদের দু'টো লাইন করেন। নিজে সবার সামনে গিয়ে "লাল পতাকা" হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। তার পর খুব ধীর গতীতে এগুতে থাকেন। সব গাড়ী থেমে ঐ দৃশ্যই দেখছে। কিন্ত আমার মনে খুব কষ্ট, আহা আমার ছেলেটি যদি ঐ দলে থাকতো?

এ নিয়ে ৩টি স্কুলে ভর্তি করিয়েছি, নীমতলী স্কুল, দামপাড়া পুলিশ লাইন স্কুল ও ইউনিভার্সেল কিন্ডার গার্ডেন। কোথাও যাবেনা বরং তিন স্কুলের বই ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলে দিয়েছে। সকাল ১০টা বাজলেই দামপাড়া স্কুলের সরকারী গাড়ীর ড্রাইভার ইয়াছিন হুংকার ছাড়ত, "ম্যাডাম বাবু কি রেডি?" ওরে সর্বনাস তাকে দেখে বড়দেরই পীলে চমকে যাবে। কালো কুচকুচে বিশাল বড় এক নরশার্দুল, তার পর নাকের দু'পাশে ইয়া বড় গোফ। প্রতি দিন আসা তার ডিউটি কিন্ত বাবুকে খুঁজে পাবে কোথায়? সে তো ইয়াছিনের নাম শুনলেই ভয়ে অস্থির।

পড়ালিখায় মনযোগ কম কিন্ত দুষ্টুমিতে পাকা। বড়ই চিন্তায় আছি। অবশিষ্ট এক বাক্স চক আর লিকুইড কিছু রং আছে।আমি আরবী অক্ষরে "আল্লাহু" লিখতে শিখিয়ে দিয়েছিলাম। একদিন কিচেন থেকে বের হয়ে দেখি, সারা ঘরের মেঝেতে চক দিয়ে আল্লাহু লিখে রেখেছে। বিছানার চাদরে ইচ্ছে মত প্রিয় সব কার্টুনের ছবি, রং দিয়ে এঁকেছে।

মুলত আমি কোন ব্লগার নই। ব্লগ লিখার আমার কোন ইচ্ছাও নেই । যখন থেকে গল্প, উপন্যাস পড়া শুরু করলাম, আমার প্রিয় রাইটার দের না দেখেই অনেক ভক্ত হয়ে গেলাম। মনে মনে বলতাম আহা আমি যদি এভাবে লিখতে পারতাম। আচ্ছা আপনিই বলুন, কোথায় আমার প্রিয় লেখিকা জোবায়দা গুলশানারা, অনামিকা হক লিলি, রোমানা আফাজ, রাবেয়া খাতুন, মকবুলা মঞ্জুর আর কোথায় আমি? লেখক তো প্রিয় অনেকই আছেন। লম্বা লিষ্ট বাদ দেই না হয়। আমি খুব ভালো করে ই বুঝি লেখা লেখির মত এত কঠিন কাজ আমাকে দিয়ে হবেনা।  শুধু আপনাকেই বলছি, কেন আমি লেখার মত কঠিন কাজ করতে শুরু করেছি,

২৪শে নভেম্বর আমার জন্মদিন,

২০০৯ সালের এমনই এক জন্মদিনে আমার খোকা আমাকে এসে বলে "মা" তোমার জন্য ছোট্ট এই উপহার। আমি ঠিক বুঝলাম না, উপহার তো দেখছিনা কোথাও। আমাকে ধরে নিয়ে ওর কম্পিউটারের সামনে বসালো। আমার আগ্রহ বাড়তে থাকলো। যখন উপহার দেখিয়ে বলল এটা একটা "ডোমেইন" তোমার জন্য কিনেছি। আমার আগ্রহ দপ করে মুহুর্তে নীভে গেলো।

এটা আবার কি জিনিষ? ঘটি, বাটি, থালা, বাসন এই সব উপহার না দিয়ে, কি দিলো এটা? পরে আমাকে বুঝিয়ে দিল; আমাকে বলল এটা তোমার অনলাইন ডাইরী। এখানে "আগডুম বাগডুম" তোমার যা খুশী লিখে রাখ, আর কেউ না পড়ুক অন্তত আমরা পড়বো। আমার তো মাথায় হাত, বলে কি? আমি কিভাবে লিখব? আমি তো অনলাইনে পড়া লেখাই জানি না। সেই থেকে পড়ে আছে আমার "ডোমেইন" এত বছর শুধু শুধুই তার "হোষ্টিং" দিয়ে যাচ্ছে।

আমার বাল্য শিক্ষা শুরু হলো। আমি খুব সাফল্যের সহিত প্রতিটি ক্লাস অতিক্রম করলাম। সময়ের তো একটা ব্যাপার আছে, লিখবো কখন? আচ্ছা দেখি যখন যা মনে পড়বে লিখার চেষ্টা করবো।

No comments:

Post a Comment