পরীক্ষা হলের সামনে কিছুক্ষন ছিলাম। অনেকেই প্রশ্নবানে আমাকে জর্জরিত করছেন,
প্রশ্নের ধরনটা এমনঃ- "দিদি প্রশ্ন পেয়েছেন?" "দিদি ইন্টারনেট থেকে প্রশ্ন নামাইছেন"
আমার একটাই জবাব ছিল "না"। এই না শুনে পুরান বালতির তলার মত মুখ করে দাদা/দিদিরা প্রস্তান। এই দাদা/দিদিরা খুব ভাল করেই জানেন, আমার ইন্টারনেটের একটি ক্ষেত আছে, গাছে ঝারা দিলেই ঝরঝর করে প্রশ্ন পড়বে।
সারা দেশব্যাপী নিন্দা/সমালোচনার ঝড় বইছে। প্রশ্ন পত্র ফাঁস নিয়ে অনেক রাঘব বোয়ালরা বিভিন্ন ভাবে তাঁদের ক্ষোভ এবং মন্তব্য প্রকাশ করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্টানকে দায়ী করছেন। কিন্ত একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি, আমরাই আমাদের সন্তানের ভবিষ্যত ধংস করে দিচ্ছি। একটি শিশু তার নৈতিক শিক্ষা টুকু পায় তার পরিবার থেকেই, বলুন আমরা তাদের কি শিক্ষা দিচ্ছি?
Post by Bindaas TA.
চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, আপনি মা/বাবা, ভাই/বোন, আত্নীয়, স্কুল শিক্ষক, প্রাইভেট টিউটর রাতের আঁধারে চুপিচুপি প্রশ্নপত্র খানি আপনি যার হাতে তুলে দিলেন, সে আপনার প্রতি কি ধারনা নিয়ে বড় হবে বলুন?
ছিঃ ছিঃ যারা এই জগন্য কাজটি করল, ঘেন্নায় একদলা থুথু ফেলতে ইচ্ছে করছে। না থাক বাসায় গিয়ে বেসিনে ফেলব। থুথু বুড়িগংগায় চলে যাক। গুনীজনেরা বলেন শিশুরাই নাকি দেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই কি তার নমুনা? কঁচি শিশুদের পাগলা ঘোড়ার ঝকি বানিয়ে কিসের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন? অবোধ শিশুদের দয়া করে মুক্তি দিন। দেশ বাঁচুক, আমরাও বাঁচি। সেই প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছি আমি, কবে হবে A+বর্ষন । TV পর্দায় কবে দেখব প্রলয় নাচন। যার জন্য দিতে হলো মনুষ্যত্ব বিসর্জন।
আজ বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ের খেলা চলছে, স্টেডিয়ামের সামনে অনেক ভীড়। নগর জীবনে কোথাও স্বস্তি নেই শীসা, ইট, বালি আর সুরকির সাথে মিতালী করেই টিকে থাকা।
প্রিয় স্বপ্নীল,
তোমার জন্য অনেক অনেক আদর। আজকে তোমাকে যে চিঠি লিখছি, তার উদ্দেশ্য একটাই। যাতে বড় হয়ে তুমি ভুলে না যাও, মা কোন দিন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেইনি। কিংবা অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করিনি।
তুমি প্রথম পরীক্ষা হলে যাবার পর প্রধান গেটের সামনে, ছাত্র/ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকের প্রচন্ড ভীড় ছিল। কিছুতেই ভীড় ঠেলে এগুতে পারছি না আমরা। তুমি নিজেই প্রতিবাদ করেছিলে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে। তুমি ছোট মানুষ তাও কাজ হয়েছিল। আমি এই প্রথম বুঝলাম, প্রতিবাদের ভাষা ক্ষেত্র বিশেষ প্রয়োগ করতে হয়। তোমার ভাষাটা ছিল ব্যতিক্রম। হঠাৎ তুমি প্রচন্ড রেগে গিয়ে বুক ফাটা চিৎকার করে বলছিলে এতো ভীড় কেন? এতো মানুষের ধাক্কা আমার উপর কেন?
রাগে, দুঃখে তোমার মুখটা আগুনের মত লাল হয়ে গিয়েছিল। টপ টপ করে পড়ছে চোখের পানি। এই দৃশ্য দেখে কে একজন বলল, "ঐ পকেট গেট দিয়ে ওকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে যান।" নতুন জায়গা, পথ ঘাট কিছুই চিনি না। পরে গিয়ে দেখলাম ওটা ছিল, অভিভাবকদের বিশ্রাম কক্ষের পথ।
তুমি পরীক্ষা হল থেকে এসে আমাকে জানালে, বন্ধুরা বলছে ইন্টারনেট থেকে প্রশ্ন পাওয়া যায়, ওরা তোমাকে সে পরামর্শ দিচ্ছে, আমি শুধু তোমাকে দু'টো শব্দ শিখিয়ে দিলাম। বন্ধুরা আবার যখন বলবে, তাদের উদ্দেশ্যে তুমি বলবে, আমার মা বলেছেন, ইহা অন্যায় এবং মহা অন্যায়।
তখনই তোমার জিজ্ঞাসাঃ- আচ্ছা মা গত কাল শুন্যস্থান পুরনে একটি মাত্র শব্দ আমি পারি না। বন্ধুর কাছ হেল্প নিয়ে লিখা কম্পপ্লিট করেছি। আমার কি অন্যায় হয়েছে? নাকি মহা অন্যায়? তুমি এতটাও ছোট নও। আরও আমাকে প্রশ্ন করেছিলে, মা তাহলে কি প্রতি বছর "ফাঁস করেই সবাই পাশ করে?"
এর কোন জবাব আমি দিতে পারিনি। আমি বলেছিলাম এ বছর তুমি পরীক্ষা দিচ্ছ, তাই বিষয়টা খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করছি নতুবা আমরা কিছুই জানতাম না।
পরদিন গিয়ে দেখি পরীক্ষা কেদ্রের ভিন্নরুপ। প্রধান গেটের কিছু দূরে, চেয়ার টেবিল পেতে বসে আছেন কিছু শিক্ষক। একজন যাওয়ার মত একটু খোলা শুধু শিক্ষর্থী যাবে। আমার জানতে ইচ্ছে করছিল এই বুদ্ধিটা গতকাল মাথায় এলো না কেন? আমি কক্ষনো তোমাকে বলতে পারবো না, কারা আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তোমাকে না জানিয়ে প্রশ্নপত্র ইন্টারনেট থেকে আনতে। আমি চাই তোমার শ্রদ্ধাটুকু তাদের প্রতি আজীবন অক্ষুন্ন থাকুক। তোমাকে না জানিয়ে যদি তোমার হাতে প্রশ্ন তুলে দিতাম, তাহলে কোন মুখে আমি নিজের বিবেকের আদালতে দাড়াতাম বলো?
২য় পরীক্ষা শেষ করে দৌড়ে এসে তুমি আমাকে জানালে, যে মিস তোমাকে রিসভ করেছিলেন, উনি আমার সাথে দেখা করতে চান। স্কুল মাঠে গেলাম তোমার সাথে। আমি ভাবছি কি না কি? মিস আমাকে দেখেই বললেন, "আপনি প্রধান গেটের সামনেই থাকবেন।"
আমি বলি কেন?
"কারন আপনার ছেলে একটু ইমোশনাল। গেট থেকে বের হয়েই যেন আপনাকে দেখে।" বলা বাহুল্য তোমাকে আর আমাকে সবাই চিনে ফেলেছিল প্রথম দিনই। সবাই বলছিল তোমার মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল। এবার তুমি ফিক করে হেসে ফেলবে এক আন্টি ফানি একটা কথা বলেছিলেন।
চিঠিতে লিখব না, চিঠি কেউ দেখে ফেললে তুমি আবার লজ্জা পাবে।
তোমার মনে আছে নিশ্চই? যাবার পথে সিদ্ধান্ত নিলাম অতিরিক্ত খাতির ধারী টুকু গ্রহন করবো না আমরা। সবার সাথে নির্দিষ্ট স্থানেই থাকব আমি।
৫ম পরীক্ষা চলছে, একটু পর বের হবে সবাই। হঠাৎ একজন টিচার হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে লাগলেন, সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে বলছেন। "সুমাইয়া নামের ছাত্রীর কেউ আছেন?" ১৫/২০ জন সুমাইয়ার মা দৌড়ে গেলেন। ঐ টিচার আবার এসে চেচাচ্ছেন, আসল সুমাইয়ার মা এরা কেউ নন। কি আশ্চর্য হাজার হাজার পরীক্ষার্থী, রোল নাম্বার ধরে ডাকবে।
তোমার রোল নাম্বার কিন্ত মুখস্ত করেছিলাম প্রথম দিনই, বলব? চৌদ্দ হাজার,নয়শত......
চার তলার সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হুড়াহুড়িতে মেয়েটা পড়ে তার একখানা হাত এবং পা দুটো ভেঙ্গে ফেলেছে। আমার সামনে দিয়ে চেংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। হাত খানা গলার সাথে ওড়না দিয়ে বাঁধা। আজ যদি বড় ধরনের দুঃখ জনক কোন ঘটনা ঘটে যেতো? জীবন বাজি রেখে এই কঁচি শিশুরা পরীক্ষা দিচ্ছে একটি সার্টিফিকেট পাবার আশায়।
কি হবে PSC পাশ দিয়ে?
তোমার মনটা ভীষন খারাপ হলো মেয়েটির জন্য। বার বার বলছিলে মা হাত পা ভাঙ্গা মেয়েটি ১টি মাত্র পরীক্ষা কিভাবে দিবে? স্কুল কতৃপক্ষের কাছে আমি সবিনয়ে জানতে চাই, যদি আপনারা নিশ্চিত জানেনই পরীক্ষার পুর্বরাত্রি প্রশ্ন আমাদের হাতের মুটোয় এসে যাবে, কেন তাহলে মাসুম বাচ্চাদের জুজুবুড়ির ভয় দেখান?
বাচ্চারা ভাবে, কিম্ভুৎ কিমাকার ভয়ঙ্কর কোন জন্ত একটা তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। তোমার ২য় সাময়িক পরীক্ষার আগে নোটিশ দেয়া হলো, তাদের টার্গেট অনুযায়ী নাম্বার না পেলে মডেল টেস্ট এবং সমাপনীতে অংশ গ্রহন করতে পারবে না। কারন শুধু একটাই যে কোন মুল্যে A এবং A+ হাতিয়ে নিতে হবে। যে খানে প্রতিষ্টানের ইজ্জত সম্মান জড়িত।
তুমি ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়লে। সারাক্ষন পড়া আর পড়া। আচ্ছা বলতো আমরা কি তোমাকে পড়ার জন্য কোন চাপ দিয়েছি? ফলাফল যা হলো ২টি মডেল টেস্ট দিয়ে অতিরিক্ত টেনশনে মাঝ রাতে (১ঃ৩০ মি) তুমি অজ্ঞান হয়ে গেলে।
ডাক্তার ব্রেইন রিলাক্স, নার্ভ রিলাক্স এর ঔষধ আরও কত ঔষধ আর সাথে কিছু থেরাপীও দিলেন। দু'টো টেস্ট করাতে দিলেন, সিটিস্কেন আর ই-ই-জি। তোমাকে সম্পুর্ন ২ মাস বিশ্রামের থাকার নির্দেশ দিলেন ডাক্তার। তোমার পড়ার টেবিল থেকে মোটা মোটা গাইড বই এবং দেয়ালে টানানো পরীক্ষার রুটিন নামিয়ে দিলাম।
তুমি শুধু জিজ্ঞেস করছো, "মা আমার কি হয়েছে?" আমি নিজেই তো বুঝতে পারছিনা, হঠাৎ কি এমন হলো তোমার।
ডাক্তারের চেম্বার আর বিভিন্ন ল্যাবে দৌড়ে আমি ভীষন ক্লান্ত।
তোমার সিটিস্কেন করার সময় ওদের দেয়া লাইফ জ্যকেট পড়ে, তোমার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। অজানা আশংকায় সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। যেদিন ই-ই-জি টেস্ট করলো, তোমার পুরো মগজটাই এল-সি-ডি মনিটরে চোখের সামনে আমি দেখতে পাচ্ছি। ডাক্তার ভাজে ভাজে, পরতে পরতে খুলে দেখছেন। প্রায় ২ঘন্টা ৪৫ মিনিট আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম ঐ মনিটরের দিকে। রেড সিগন্যাল দিলেই মনে হয় এই বুঝি, ভয়ঙ্কর কিছুর সন্ধান পেলো।
তুমি তো জাননা ঐ সময়টা আমার কি অস্থিরতায় কেটেছে। তুমি কিন্ত আমাকে আজও বলনি, কি এমন টেনশনে তোমাকে জ্ঞান হারাতে হলো? তোমার রিপোর্ট দুটো চিঠির সাথেই সংযুক্ত করে রাখব। বড় হয়েও যাতে খুঁজে পাও।
আমরা আর জানবো না, তোমার মত কত স্বপ্নীল/স্বপ্নার পরীক্ষা কাহিনী।
আমি তোমাদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছি, কিন্ত অদৃশ্য শিকলে বেঁধে রেখেছি পা-দুটি। ইচ্ছে করলেই তোমরা সিলেবাসের বাইরে যেতে পার না। আমার চোখের আড়াল হলে আমি তোমাদের খুজি না। যন্ত্রনা এবং দায়বদ্ধতা থেকেই তোমাদের অবস্থান আমাকে জানিয়ে দাও। প্রত্যেক মা ও সন্তানের এমন সম্পর্কই থাকা খুব বেশী প্রয়োজন।
খোকা, তুমি সবে মাত্র পড়া লিখা শুরু করেছ, আমি জানিনা তুমি বড়শিক্ষিত, মেজশিক্ষিত, ছোটশিক্ষিত নাকি অশিক্ষিত হবে। আমার একটাই চাওয়া তুমি একজন ভাল মানুষ হও বাবা।
পড়ালেখা তো ডালভাত না, মা এক থালায় ভাত, ডাল, হাঁসের ডিম সিদ্ধ, লেবু কাঁচা মরিচ দিয়ে খুব ভালকরে মেখে তোমাদের খাইয়ে দেব। তুমি তো জানই, যখন ইন্টারনেটের নাম পর্যন্ত শুনিনি, শখ করে তোমার ভাইয়াকে একখানা কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলাম।
আমার জনৈক প্রতিবেশী বললেন "সন্তান নষ্ট হয়ে যাবার জন্য, একখানা কম্পিউটারই যথেষ্ট।" তার পর আসলো স্যাটেলাইট আরো ভয়ঙ্কর সেটা। সর্বশেষ অতি ভয়ঙ্কর ইন্টারনেট। আমি এগুলোর প্রয়োজন মনে করেই বাসায় রেখেছি। তোমাদের শুধু বলেছি, সব কিছুরই ভাল এবং মন্দ দুটো দিক রয়েছে। আমি চাই তোমরা ভালটুকু গ্রহন করো আর মন্দটুকু বর্জন কর।
আমি,তোমার কোন ফাটাফাটি রেজাল্টের আশা করি না বাবা, তুমি মোটামুটি রেজাল্ট নিয়ে ঘরে এসো। আমি জানব আমার খোকা যেটুকু অর্জন করেছে, এতে কোন ভেজাল নেই।
অনেক অনেক দোয়া থাকলো তোমার জন্য।
ইতি,
তোমার মা
ভাবছি স্বপ্নীলকে একটা চিঠি লিখব। ও খুব খুশী হবে। ওকে তো এই ডিজিটাল যুগে কেউ চিঠি লিখেনি। হ্যা আমাকে অবশ্যই লিখতে হবে, PSC পরীক্ষায় যে ইতিহাস রচনা করেছ তোমরা, আমি তা জীবনেও ভুলবো না বাবা।
হাটছি আর ভাবছি। হঠাৎ কে একজন পিছন থেকে প্রশ্ন করলো, "দিদি কি বাসায় গিয়েছিলেন?" আমি একটু ঘুরে আবারও জবাব দিলাম "না।" এসে পড়েছি পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনেই, প্রতিক্ষায় আর অজানা আশংকায় প্রহর গুনছি। ছেলেটি অক্ষত অবস্থায় বের হতে পারবে তো?
No comments:
Post a Comment